রবিবার ০৫ মে ২০২৪
Online Edition

‘দোষ স্বীকার করে’  নাঈম আশরাফের জবানবন্দী 

 

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : রাজধানীর বনানীর জোড়া ধর্ষণ মামলার আসামী প্লেবয় নাঈম আশরাফ রিমান্ড শেষে আদালতে ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী’ দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। সাত দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার নাঈম আশরাফকে আদালতে নিয়ে আসার পর এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের পরিদর্শক ইসমত আরা এমি আসামীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী রেকর্ড করার জন্য হাকিমের কাছে আবেদন করেন। মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদার পরে তার খাস কামরায় নাঈম আশরাফের জবানবন্দী রেকর্ড করেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপ কমিশনার ( ডিসি ) মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, আসামী নাঈম আশরাফ তার জবানবন্দীতে নিজের ও অন্য আসামীদের অপরাধে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।” 

গত ১৭ মে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থেকে নাঈম আশরাফকে গ্রেপ্তার করা হয়, যার আসল নাম হাসান মোহাম্মদ হালিম। পরদিন তাকে ঢাকার হাকিম আদালতে হাজির করা হলে বিচারক জামিন নাকচ করে তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। গতকাল বৃহস্পতিবার জবানবন্দী দেওয়ার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয় বলে উপ কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান জানান।

এ ধর্ষণ মামলার বাকি চার আসামী আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ, তার বন্ধু সাদমান সাকিফ, সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী এবং গাড়িচালক বিল্লাল হোসেনও ইতোমধ্যে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। 

গত ৬ মে বনানী থানায় দায়ের করা এ মামলার এজাহারে বলা হয়, ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের দাওয়াতে ডেকে নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন সাফাত ও নাঈম। বাকি তিনজন তাদের সহযোগিতা করেন। সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের হালিম নাম ভাঁড়িয়ে ঢাকায় নাঈম আশরাফ নামে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা চালাচ্ছিলেন বলে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর প্রকাশ পায়। গত ৬ মে মামলার পর গণমাধ্যমে নাঈমের ছবি দেখে তাকে হালিম বলে শনাক্ত করেন সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের গাইন্দাইল গ্রামের বাসিন্দারা। হালিম ওই গ্রামের ফেরিওয়ালা আমজাদ হোসেনের ছেলে। এলাকায় প্রতারক হিসেবে তার পরিচয় ছিল। গ্রামবাসী জানায়, হালিম প্রভাবশালী বিভিন্ন জনকে তার বাবা পরিচয় দিয়ে নানা সুবিধা আদায় এমনকি বিয়েও করেছিল দুই বার।

ঢাকায় এসে নাঈম আশরাফ নাম নিয়ে ‘ই-মেকার্স’ নামে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান খুলে ২০১৪ সালে ভারতের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী অরিজিৎ সিংয়ের কনসার্টের আয়োজন করেন তিনি। ২০১৬ সালে ঢাকায় ভারতের আরেক শিল্পী নেহা কাক্কারকে নিয়ে ‘নেহা কাক্কার লাইভ ইন কনসার্ট’ অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেন নাঈম বা হালিম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাঈম বিভিন্ন জনের সঙ্গে নিজের সেলফি দিতেন, যা সুবিধা নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হত বলে এখন মনে করছেন ওই ছবিতে থাকা ব্যক্তিরা। নিজেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা পরিচয় দিয়ে হালিম এলাকায় পোস্টার-ব্যানারও লাগাতেন; যদিও সংগঠনে তার কোনো পদ ছিল না বলে জানান স্বেচ্ছাসেবক লীগের কাজীপুরের নেতারা। আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাতের সঙ্গে নাঈমের নিবিড় ঘনিষ্ঠতার কথা সাফাতের সাবেক স্ত্রী ফারাহ মাহবুব পিয়াসাও জানিয়েছেন। সাফাত সব সময় নাঈমের কথায় চলতেন বলে পিয়াসার ভাষ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাঈমের নিজের পাতায় সাফাতের বাড়িতে পারিবারিক আবহে ছবিতে তাকেও দেখা যায়। অভিযোগকারী তরুণীদের দাবি, সেদিন রেইনট্রি হোটেলে নাঈম ও সাফাত ধর্ষণের পাশাপাশি তাদের নির্যাতনও করেন। পা ধরে নিস্তার চাইলেও তারা ছাড়া পাননি।

রেইনট্রি কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ 

দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় দ্য রেইনট্রি হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদনান হারুন ও জেনারেল ম্যানেজার ফ্রাংক ফরগেটকে মানবাধিকার কমিশনের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গতকাল বিকাল সোয়া চারটার সময়  কমিশনে পৌঁছেন এই দুইজন। সাড়ে পাঁচটার পর জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে তারা চলে যান। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার দিন মানবাধিকার লংঘন হয়েছে কিনা তা জানতে এদের গত মঙ্গলবার (২৩ মে) তলব করেছিল কমিশন। এই তলবের প্রেক্ষিতে গতকাল বেলা সোয়া চারটার দিকে তারা কমিশনে পৌঁছেন। একইদিন গুলশান জোনের ডিসি মোশতাক আহমেদ ও বনানী থানার ওসি ফরমান আলীকেও তলব করেছিল। তবে পুলিশের এই দুই কর্মকর্তা গতকাল মানবাধিকার কমিশনে আসেননি। 

এর আগে বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার তদন্ত করতে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এই তদন্তের অংশ হিসেবে কমিশন এরই মধ্যে ওই দুই তরুণীর সঙ্গে সেদিনের ঘটনা নিয়ে কথা বলে। পরে মানবাধিকার কমিশনের দুই সদস্য ঘটনাটির তদন্তে ১৩ মে ঘটনাস্থল রেইনট্রি হোটেল পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়াও ভিকটিম ও তাদের পরিবার সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ারও আহ্বান জানায় কমিশন।

ঘটনার দিন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছিলো।

‘প্রস্তুতির অভাবে’ মানবাধিকার কমিশনে যাননি ডিসি- ওসি

তদন্ত কমিটির তলবে যাননি বনানী থানার ‘বিতর্কিত’ ওসি বিএম ফরমান আলী ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ। ‘প্রস্তুতির অভাবে’র কথা উল্লেখ করে হাজিরা দেয়ার জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে আবেদন করেছেন এই দুই কর্মকর্তা। গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম এ কথা জানান। তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা প্রস্তুতি ও তাদের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য সময় চেয়েছেন। আমাদের কমিটির আগামী সভা আগামী ৪ জুন রোববার। সেদিন বিকেল ৪টায় তাদের আবারও তলব করা হয়েছে।

মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে পুলিশের ‘অসহযোগিতা’ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে নজরুল ইসলাম বলেন, তারা (পুলিশ) সেলফ ডিফেন্সের জন্য সময় নিয়েছে। আমরা কোনো অসহযোগিতা দেখছি না।

রেইনট্রিতে একজনের বুকিংয়ে আরেকজন থাকে কিভাবে

তদন্ত কমিটি দ্য রেইট্রি হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদনান হারুন ও জেনারেল ম্যানেজার ফ্রাংক ফরগেট এর কাছে জানতে চেয়েছিল একজনের নামে রুম বুকিং নিয়ে আরেকজন থাকে কিভাবে? রেইট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষের  দুই কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্দিষ্ট দুই জনের নামে হোটেল বুকিং দিয়ে অন্যরা থাকে কিভাবে  তা জানতে চেয়েছি।’

তদন্ত কমিটির প্রধান সাংবাদিকদের বেলেন, ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে রেইট্রির সম্পৃক্ততা কতটুকু তা জানার জন্য তাদের (রেইনট্রির কর্তৃপক্ষের দুই কর্মকর্তা) ডাকা হয়েছিল।  হোটেলে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশের বিষয়টিও জানার চেষ্টা করেছেন বলে সাংবাদিকদের উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে যেসব তথ্য জানার দরকার ছিল, তা আমরা জানতে চেয়েছি। তারা তাদের মতো করে প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। অস্ত্রের ব্যাপারে তারা বলেছেন, অস্ত্র  ফ্রন্ট ডেস্কে রেখে দিয়েছিলাম।’

তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়ে মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ১৫ দিনের সময় ছিল। তদন্ত চলছে প্রতিবেদন আগামী ৪ জুনের পরপরই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চেষ্টা করবো।’

জিজ্ঞাসাবাদের তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বলেন, আমরা রেইন ট্রির দুজনের সঙ্গে কথা বলেছি। সেদিন রাতে তাদের ব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চেয়েছি। তারা আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেন, তারা ( হোটেল কর্তৃপক্ষ) বলেছেন, এ ঘটনায় তারা সমাজের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন। তাদের মানবাধিকারও লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে আমাদের জানিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

 রেইন ট্রির বক্তব্যে তদন্ত কমিটি সন্তুষ্ট কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সন্তুষ্টির বিষয় এখনও বলা যাচ্ছে না। আমরা মাত্র তাদের কথা শুনলাম, এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের বিষয় রয়েছে।’

 সেই রাতে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের ধর্ষণ করা হয়েছিল বলে ওই দুই তরুণী যে অভিযোগ করেছেন সে বিষয়ে আমরা রেইন ট্রি’র কাছে জানতে চেয়েছি। তারা বলেছেন, অস্ত্রটি তাদের ফ্রন্ট ডেস্কে জমা রাখা হয়েছিল। হোটেল কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী সেটা ফ্রন্ট ডেস্কে সংরক্ষিত ছিল।

দুই তরুণীকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, তদন্তের স্বার্থে ভিকটিম দুই তরুণীকে আনুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।

‘পদে পদে লাঞ্ছিত হচ্ছি, রেইন ট্রি ধ্বংসের পথে’

মানবাধিকার কমিশনের গঠিত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন হোটেলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিএএইচ আদনান হারুন। এসময় আদনান হারুন বলেন, আমি এবং আমাদের এখানে কর্মরত স্টাফরা পদে পদে লাঞ্ছিত হচ্ছি। অনেকে ভয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে সামাজিক মর্যাদার কারণে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। সম্প্রতি হোটেলটি নিয়ে যা হচ্ছে, একজন মালিক হিসেবে আমি বলতে চাই ‘দ্য রেইন ট্রি’ ধ্বংসের মুখে।

 সেই রাতের ঘটনার পর থেকে রেইন ট্রি এবং এর কর্মচারীদের সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে দাবি করে আদনান হারুন বলেন, ‘আমাদের মানবাধিকারের কী হবে?’

জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে তিনি বলেন, তারা (তদন্ত কমিটি) জানতে চেয়েছেন সেদিন রাতে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে কি না। আমরা তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। যদি এ ঘটনায় কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘন করে থাকে আমরাও তাদের বিচার চাই।

সেই রাতের পর হোটেল থেকে একটি টাওয়াল হারিয়ে গেছে, কয়েকজন কর্মীও হোটেলের চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আদনান হারুন বলেন, শুনেছি অনেকে ভয়ে ও সামাজিক কারণে চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। কতজন গেছেন এটা বলতে পারছি না। আর টাওয়ালের বিষয়ে হোটেলের অপারেশনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা স্পষ্ট করে বলতে পারবেন, এটি আমার জানার কথা না।

গতকাল বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ে হাজির হন দ্য রেইন ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিএএইচ আদনান হারুন এবং মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ফ্রাঙ্ক ফরগেট। তাদের সঙ্গে একজন আইনজীবীসহ আরও চারজন হাজির হন। তবে অন্যদের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তাদের (হোটেলের এমডি, জিএম) দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ